অংশগ্রহণমূলক পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেয়ার পক্ষে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট
বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যাশা পূরণে রাজনীতিবিদরা ব্যর্থ হলে যুক্তরাজ্যের কঠোর অবস্থান নেয়া প্রয়োজন বলে মত প্রকাশ করেছে গণতন্ত্র চর্চার তীর্থস্থান হাউস অব কমন্স। গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত রাখতে অংশগ্রহণমূলক পরবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে সময়সীমা বেঁধে দেয়ার পক্ষেও মত ব্রিটিশ এমপিদের।
বুধবার যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট হাউস অব কমন্সের ওয়েস্টমিনিস্টার হলে বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন ও চলমান পরিস্থিতি নিয়ে অনুষ্ঠিত বিতর্কে ব্রিটিশ এমপিরা এসব কথা বলেন। এ বিতর্কে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি না করতে জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করারও আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
আধা ঘণ্টারও বেশি সময়ের এই বিতর্কে অংশ নেন লেবার পার্টির এন্ড্রু স্মিথ, জিম কানিংহাম এবং কনজারভেটিভ পার্টির রেহমান চিশতি। আলোচনার সমাপ্তি টানেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী হিউ রবার্টসন।
বিতর্কের শেষ আলোচনায় পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিউ রবার্টসন বলেন, ব্রিটেনের প্রতিক্রিয়াকে তিনটি ভাগে দেখা যায়। প্রথমত, নির্বাচনে অংশগ্রহণের অভাব এবং সহিংসতার জন্য আমরা প্রকাশ্যেই হতাশা প্রকাশ করেছি। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি দীর্ঘস্থায়ী ও টেকসই সমাধানের লক্ষ্যে সংলাপ শুরুর জন্য আমরা দেশটির রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। তৃতীয়ত, একটি যথাযথভাবে সচল গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
হিউ রবার্টসন বলেন, ব্রিটিশ সরকার মনে করে গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে জনগণের আকাঙক্ষার প্রতিফলন হওয়া দরকার। ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী হলেও তাতে প্রধান বিরোধী দল অংশগ্রহণ করে নি। অর্ধেকের বেশি ভোটার ভোট দেয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণের সত্যিকার আকাঙক্ষার প্রতিফলন এবং সত্যিকার গণতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
ব্রিটিশ মন্ত্রী বিগত বছরের রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহতদের সংখ্যা উল্লেখ করে বলেন, ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫শতাধিক লোক নিহত হয়েছে। শুধুমাত্র নির্বাচনের দিন মারা গেছে ২১ জন। ভোটের দিন শতাধিক ভোটকেন্দ্রে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। মৃত্যু এবং ধ্বংসাত্ম কার্যক্রম আমাকে এবং এই হাউসের সবাইকে ব্যথিত করেছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে কঠোর হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ যুক্তরাজ্যে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। বাংলাদেশের জনগণের আকাঙক্ষার স্থিতিশীল, উন্নত এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য আমাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু যদি রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের এ আকাঙক্ষা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হয় তাহলে আমরা কঠোর হতে দ্বিধা করব না।
বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে হিউ বলেন, রাজনৈতিক হয়রানি এবং ক্রমবর্ধমান অস্থিরতায় আমরা উদ্বিগ্ন। বিএনপির কয়েকজন নেতা ও অফিস থেকে অবরোধ তুলে নেয়ায় কিছুটা আশাবাদ দেখা গেলেও তা যথেষ্ট নয়।
এ অবস্থা অবসানে সব রাজনৈতিক দলে আরো দৃঢ় পদক্ষেপ প্রয়োজন এবং এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য সহযোগিতা করবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের মঙ্গলের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত আলোচনায় বসে দীর্ঘমেয়াদী সমাধান বের করা।
এর আগে উদ্যোক্তা বিরোধী দল লেবার পার্টির এমপি, ছায়া মন্ত্রিসভায় বৈদেশিক উন্নয়ন-সহায়তা দপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত ছায়া প্রতিমন্ত্রী গ্যাভিন শুকার তার বক্তব্য তুলে ধরেন। বিতর্কের শুরুতে গ্যাভিন শুকার ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্মলাভের পর থেকে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে বলেন, আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও অন্যান্য দলের মধ্যকার পারস্পরিক অবিশ্বাস একটি অকার্যকর রাজনৈতিক পরিবেশের চিত্র তুলে ধরে, যেখানে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব বলেই প্রতীয়মান হয়।
তিনি বলেন, কাগজে কলমে ৩০০টির মধ্যে ২৩২ টি আসন আওয়ামী লীগ জিতেছে। কিন্তু বাস্তবতা ছিল অন্য রকম। মাত্র ১০ শতাংশ ভোটার ভোট দিয়েছে এবং প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন বয়কট করেছে। অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আ.লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছে। ভোট কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্কুল পুড়েছে এবং ২১ জনের প্রাণহানি হয়েছে।
গ্যাভিন শুকার বাংলাদেশে চলতি বছরে ৭৫০ কোটি পাউন্ড উন্নয়ন-সহায়তা বরাদ্দ থাকার কথা উল্লেখ করে বলেন, এর এক-তৃতীয়াংশ সরাসরি সরকারের কাছে যাবে এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যাবে রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়ানো এবং নিরাপত্তা ও বিচারব্যবস্থার উন্নয়নে।
তিনি ব্রিটিশ সহায়তা কার্যক্রম বন্ধ না করে জরুরি ভিত্তিতে তা পর্যালোচনা করা এবং পর্যালোচনার ফলাফল প্রকাশের আহ্বান জানান।
৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন না ঘটা এবং নতুন বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের আহ্বান বিষয়ে অস্ট্রেলীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলি বিশপ, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র, ফরাসি ও জার্মান সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং ঢাকায় জাপানি রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য উদ্ধৃত করে গ্যাভিন শুকার বলেন, ব্রিটেনের এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বের ভূমিকা গ্রহণ করা উচিত।
তিনি নতুন সরকারের প্রতি রাশিয়া, ভারত, চীন, ভিয়েতনাম ও নেপাল সরকারের সমর্থনের কথা উল্লেখ করে বলেন, সব দেশের ভূমিকা অবশ্য এ ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। উভয় পক্ষের দ্বারা সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা করে তিনি সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দেয়ার আহ্বান জানান।
এন্ড্রু স্মিথ বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের অন্যতম মৌলিক একটি সমস্যা হচ্ছে, অতীতের নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে যে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা কার্যকর ছিল, সেটি অনুসরণে আওয়ামী লীগের অস্বীকৃতি।
জিম কানিংহাম বলেন, নির্বাচন তদারকির জন্য একটি অন্তরবর্তী সরকারের অনুপস্থিতি দেশটির জন্য একটি বড় বিপর্যয়। বিরোধীদের হয়রানি এবং বিদ্রুপ করা বন্ধের জন্য জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা প্রয়োজন বলেও কানিংহাম মন্তব্য করেন।
Comments
Post a Comment